সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১২

বাংলা খবর: ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে বিশ্বনাথ

ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে বিশ্বনাথ
* থানায় হামলা * ইউএনও অফিসে আগুন * নিহত ২ * ওসিসহ আহত অর্ধশতাধিক

শাহ্ দিদার আলম নবেল ও সাইফুল ইসলাম বেগ, সিলেট অফিস

বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ঘটনায় ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে তার নিজ উপজেলা বিশ্বনাথ। বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষে গতকাল গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন এক যুবদল কর্মীসহ দুজন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। ক্ষুব্ধ হরতালকারীরা বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদ ভবনে আগুন লাগিয়ে দেন। তারা উপজেলা কর্মকর্তার গাড়িসহ ১০টি যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া উপজেলা কমপ্লেঙ্রে সব কটি সরকারি দফতরের আসবাব ও কাগজপত্রাদিও পুড়িয়ে দেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ প্রায় দুই শতাধিক রাউন্ড কাঁদুনে গ্যাস ও গুলি ছোড়ে। সংঘর্ষ চলাকালে বিশ্বনাথ থানার ওসি, ১৫ পুলিশসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সিলেট জেলা সভাপতি ইলিয়াস আলীর উদ্ধারের দাবিতে দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও রাস্তায় নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষ। হরতাল চলাকালে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। সকাল থেকে উপজেলা সদরের বাসিয়া সেতুর ওপর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। অপর দিকে বিএনপি নেতা-কর্মীরা উপজেলা সদরের পাশর্্ববর্তী নকিখালি ও জানাইয়া এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় পুরো উপজেলায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করে। বেলা ২টার দিকে পৃথক মিছিল নিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা রামপাশা ও জানাইয়া সড়ক দিয়ে উপজেলা সদরে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় মিছিলকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে কাঁদুনে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে পুলিশও পাল্টা জবাব দেয়। প্রায় এক ঘণ্টা সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ পিছু হটলে বিএনপি নেতা-কর্মীরা বাসিয়া সেতু থেকে থানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। একপর্যায়ে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে মনোয়ার মিয়া নামে এক যুবদল কর্মী গুরুতর আহত হন। তাকে ওসমানী হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। এ ছাড়া জামেয়া মোহম্মদিয়া মাদ্রাসার পাশ থেকে গুলিবিদ্ধ আরেক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সংঘর্ষে বিশ্বনাথ থানার ওসি (তদন্ত) চান মিয়া, সেকেন্ড অফিসার এনাম আহমদ, এসআই সালাহ উদ্দিনসহ ১৫ পুলিশ সদস্য এবং বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন। এর মধ্যে অন্তত ১০ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সংঘর্ষ চলাকালে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপজেলা কমপ্লেঙ্ েহামলা চালান। তারা বিভিন্ন সরকারি অফিসে ভাঙচুর করেন। অফিস থেকে আসবাব, কাগজপত্রাদি ও কর্মকর্তাদের সাতটি মোটরসাইকেল কমপ্লেঙ্রে আঙিনায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেন। হরতাল সমর্থকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনেও হামলা চালান। এ সময় তারা ইউএনওর গাড়িও পুড়িয়ে দেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ অন্তত ২০০ রাউন্ড কাঁদুনে গ্যাস ও শর্টগানের গুলি ছোড়ে। বিকাল ৪টার দিকে বিপুলসংখ্যক র্যাব-পুলিশ-বিজিবি সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

সিলেট নগরী : গতকাল সকাল থেকে সিলেট নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। কিন্তু র্যাব-পুলিশের মারমুখী অবস্থানের কারণে তারা মিছিল-সমাবেশ করতে পারেননি। দুপুরের দিকে চৌহাট্টা, বালুচর, যতরপুর, উপশহর ও মানিকপীর রোড এলাকায় পাঁচটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন হরতালকারীরা। এ সময় অর্ধশত গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বেলা ১টা থেকে নগরীতে র্যাব-পুলিশের টহল জোরদার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী আরও মারমুখী হয়ে উঠলে হরতালকারীরা পিছু হটেন। বিকালে আবারও তারা রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগের চেষ্টা চালান। এ সময় নগরীর শিবগঞ্জে ২০-২৫টি গাড়ি ভাঙচুর ও বালুচরে আরেকটি গাড়িতে আগুন দেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া বিকালে মোটরসাইকেলে আসার পথে মেজরটিলায় ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। নির্দেশ না মানায় তাদের লক্ষ্য করে শর্টগানের গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা ইকরাম হোসেন, জিলু ও ছাত্রদল নেতা বজলু আহত হন। শিবগঞ্জ থেকে আটক করা হয় ছাত্রদল নেতা কাওছার আহমদ রানা ও সাজু আহমদকে। সকালে হরতালের সমর্থনে নগরীর মিরাবাজার থেকে একটি মিছিল বের করে ছাত্রদল। মিছিলটি নাইওরপুল পয়েন্টে এলে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হয়ে আবার মিরাবাজার ফিরে যায়। পরে সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তৃতা করেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামান, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা ফরহাদ চৌধুরী শামীম, দিনার খান হাসু, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল আহাদ খান জামাল প্রমুখ। বেলা ১১টার দিকে আম্বরখানা থেকে বিএনপি মিছিল বের করলে চৌহাট্টা সিভিল সার্জন অফিসের সামনে বাধা দেয় পুলিশ। পরে সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তৃতা করেন বিএনপি নেতা ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী, আবুল কাহের শামীম, আরিফুল হক চৌধুরী, সালেহ আহমদ খসরু, মাহবুব চৌধুরী প্রমুখ।

কোম্পানীগঞ্জ : বেলা ১১টায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ কালাসাদেক বিজিবি ক্যাম্পের পাশ থেকে মিছিল বের করেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা দুটি ট্রাক ভাঙচুর করলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন।

কানাইঘাট : সকালে কানাইঘাট সদরে বিএনপি মিছিল বের করলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হন।

বালাগঞ্জ : উপজেলার কালীবাড়ি বাজার, আদিত্যপুর, মোরারবাজার, নতুনবাজার, বোয়ালজুড়, ইলাশপুর, গহরপুর মাদ্রাসাবাজার, আজিজপুর বাজার, জনকল্যাণ বাজার, ওসমানীগঞ্জ বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং করেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। সমাবেশে বক্তৃতা করেন বিএনপি নেতা কামরুল হুদা জায়গীরদার, গেদাই মিয়া, ফারুক মিয়া প্রমুখ।

ওসমানীনগর : সমাবেশে বক্তৃতা করেন বিএনপি সভাপতি সৈয়দ মোতাহির আলী, আবদাল মিয়া, ইমরান রব্বানী, ফখরুল ইসলাম ফারুক, আনহার মিয়া প্রমুখ।

দক্ষিণ সুরমা : দক্ষিণ সুরমার বিভিন্ন পয়েন্টে পিকেটিং ও মিছিল করেন বিএনপি কর্মীরা। সমাবেশে বক্তব্য দেন এ টি এম ফয়েজ, তাজরুল ইসলাম তাজুল, কোহিনুর আহমদ, মকসুদ আহমদ প্রমুখ। দক্ষিণ সুরমা থেকে ২৩ জনকে আটক করে পুলিশ।

গোয়াইনঘাট : সমাবেশে বক্তৃতা করেন বিএনপি নেতা সিরাজউদ্দিন, লুৎফুল হক খোকন প্রমুখ।

জৈন্তা : হরতাল চলাকালে উপজেলা সদরে মিছিল করে বিএনপি। সমাবেশে বক্তৃতা করেন এম এ মালিক মানিক, মুহিবুল হক প্রমুখ।

জকিগঞ্জ : সোমবার জকিগঞ্জ উপজেলার সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে সমাবেশে বক্তৃতা করেন বিএনপি নেতা বদরুল হক খসরু, জাহাঙ্গীর শাহ চৌধুরী হেলাল, ইসমাঈল হোসেন সেলিম।

সিলেটে ১৪ দল নেতাদের উদ্বেগ : ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সিলেটের ১৪ দল নেতারা। রবিবার রাতে সভা করে তারা এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইলিয়াস আলীর সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসে রাজনীতিতে ফের সক্রিয় হওয়ার কামনা করেন ১৪ দলের নেতারা। একই সঙ্গে তারা এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে সরকারকে সহযোগিতা করতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, জেলা সভাপতি আবদুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান, সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি, জেলা জাসদ সভাপতি কলন্দর আলী, সাধারণ সম্পাদক লোকমান আহমদ, ন্যাপের সৈয়দ আবদুল হান্নান, ওয়ার্কার্স পার্টির সিকন্দর আলী, গণতন্ত্রী পার্টির ব্যারিস্টার আরশ আলী, সাম্যবাদী দলের ধীরেন সিংহ প্রমুখ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন