ঢাকা, এপ্রিল ১৬ - ব্যক্তিগত সহকারীর ‘অর্থ কেলেঙ্কারির’ দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
এক সপ্তাহ ধরে নানা নাটকীয়তার পর সোমবার রেলভবনে সংবাদ সম্মেলন করে ‘অব্যাহতি’ নেওয়ার এই ঘোষণা দেন পাঁচ মাস আগে মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়া বর্ষীয়ান এই আওয়ামী লীগ নেতা।
এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িতে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়ার পর চাপের মধ্যে থাকা সুরঞ্জিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও আমি অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
পরে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেবেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে গাড়ি থেকে জাতীয় পতাকা নামিয়ে রেলভবন ছাড়েন তিনি। গত ২৮ নভেম্বর মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর গাড়িতে তোলা জাতীয় পতাকা নিয়েই তিনি সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে বাকপটু হিসেবে পরিচিত সুরঞ্জিতকে প্রায় ২০ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে বেশ বিমর্ষ দেখা যায়। তার স্বভাবসুলভ হাসিমুখও এদিন দেখা যায়নি।
তবে বাংলাদেশের প্রায় সব সংসদেই প্রতিনিধিত্বকারী এই সংসদ সদস্য বলেছেন, মন্ত্রিত্ব ছাড়লেও ৫০ দশকের রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটছে না, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করে রাজনীতিতে ফিরবেন তিনি।
সুরঞ্জিত হলেন বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। এর আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ পদত্যাগপত্র দেন।
নিজের সিদ্ধান্তেই পদত্যাগ- সুরঞ্জিত এই কথা বললেও তার পদত্যাগ চেয়ে আসা বিএনপি ঘোষণা আসার পর বলেছে, আওয়ামী লীগের এই নেতাকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে ‘বাধ্য’ করা হয়েছে।
অন্যদিকে দলীয় নেতার এই সিদ্ধান্ত স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, “তিনি কোনো রকম অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না।
“তার এই পদত্যাগ রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। অতীতে আর কোনো রাজনীতিবিদ ব্যর্থতার দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে এভাবে পদত্যাগ করেননি।”
যে ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিতকে পদত্যাগের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে এই ঘটনার শুরু গত ৯ এপ্রিল রাতে।
ওই রাতে রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরের ফটকে সুরঞ্জিতের এপিএস, এক সময়ের ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুকের গাড়িতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওয়ার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে তা নিয়ে শোরগোল শুরু হয়।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ওই রাতে ফারুকের সঙ্গে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যায়, যা রেলে নিয়োগে ঘুষ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। পূর্বাঞ্চল রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা এবং জিআরপির ঢাকার কমান্ডেন্ট এনামুল হকও ছিলেন ওই গাড়িতে।
ঘটনাটি নিয়ে সারাদেশে গুঞ্জন শুরু হলে পরদিন রেল ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত এই ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি করার কথা জানালেও এতে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন তিনি; যদিও সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া ওই গাড়ির আরোহীদের বক্তব্য ছিল, তাদের গন্তব্যস্থল ছিল রেলমন্ত্রীর বাড়ি।
এরপর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় চলতে থাকলে রোববার জিএম ইউসুফ মৃধা ও কমান্ডেন্ট এনামুলকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ওমর ফারুককে চাকরিচ্যুত করার কথা জানান সুরঞ্জিত।
বিষয়টি তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পৃক্ত করার কথাও জানান তিনি। মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ওমর ফারুক ও তার স্ত্রী মারজিয়া ফারহানার ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) জব্দ করার নির্দেশও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে ঘটনার শুরু থেকে পদত্যাগের দাবি উঠলেও তা রোববার বিকাল পর্যন্ত নাকচ করে আসছিলেন সুরঞ্জিত।
তবে রোববার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আসার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। তখন থেকেই গুঞ্জন শুরু হয়, পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন রেলমন্ত্রী। সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে তার অনুপস্থিতি আরো জোরালো করে সেই গুঞ্জনকে।
‘রেলমন্ত্রী’ পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন-এমন খবরে গণমাধ্যমকর্মীরা সকাল থেকেই রেল ভবনে জড়ো হতে থাকেন। সংবাদ সম্মেলন বেলা ১২টায় শুরুর কথা থাকলেও মন্ত্রী রেলভবনে আসেন পৌনে ১টার পর, গাড়িতে তখন ছিল জাতীয় পতাকা।
নিজের কক্ষে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু তাহের ও রেলসচিব ফজলে কবিরকে নিয়ে মন্ত্রী সম্মেলন কক্ষে পৌঁছান ১টা ১০ মিনিটে।
“আজ আমি বেশি কথা বলতে পারব না। কোনো প্রশ্ন নেব না। প্রশ্নের উত্তরও দেব না,” মন্ত্রী হিসেবে শেষ সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন রাজনৈতিক অঙ্গনে সবসময় সরব সুরঞ্জিত।
জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির দায় দায়িত্ব একান্তই তার, দল বা সরকারের নয়। ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও গণতন্ত্রকে ‘আরো শক্তিশালী’ করতে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
“গত রোববার প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর আমি প্রায় ঘণ্টাকাল তার সঙ্গে বৈঠক করেছি। বৈঠকে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অব্যাহতির অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে তিনি তাতে সম্মতি দেন।”
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “গত ৯ই এপ্রিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরে একটি নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। নানা কথা হচ্ছে। যেহেতু এই ঘটনায় আমার এপিএস ও রেল মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা জড়িত ছিল, তাই এই ঘটনার দায়দায়িত্ব আমার মন্ত্রণালয়ের ওপরই পড়ে।”
৫০ বছরেরও বেশি সময় রাজনীতিতে যুক্ত এই নেতা আফসোসের সুরে বলেন, “চল্লিশ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ৪০ বছরে কেউ আত্মত্যাগ করতে আসে নাই।”
“আমি আমার জীবন সায়াহ্নে এসে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছি,” বলেন সুরঞ্জিত; এই কেলেঙ্কারির পর কয়েকদিন আগেও তিনি বলেছিলেন, “এতদিন তীর ছুড়ে এসেছি, এখন নিজেই তীরবিদ্ধ। তীরের যন্ত্রণা যে কী, তা বুঝতে পারছি। কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কীসে,,,,,।”
এই অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে নিজে কোনোভাবে জড়িত নন দাবি করে সুরঞ্জিত বলেন, “দেশের বুদ্ধিজীবী ও আমার দলের ২/১ জন ছাড়া বেশিরভাগই প্রশ্ন করছেন, আমি দায়িত্বে থাকলে তদন্ত প্রভাবমুক্ত থাকবে কি না।...গণতন্ত্রের মাত্রাকে আরো শক্তিশালী করতে এই ঘটনায় আমার দায়িত্ব নিতে হবে।... এই ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও আমি অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তার এই উপলব্ধিকে সাধুবাদ জানিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও সাংবাদিকদের বলেছেন, “উনি (সুরঞ্জিত) পদে থাকায় তদন্ত সুষ্ঠু হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল। পদত্যাগ করায় এখন আর তদন্ত নিয়ে সমস্যা দেখছি না।”
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলে সংস্কারের দাবি তুলে দলে অনেকের বিরাগভাজন হওয়া সুরঞ্জিত পদত্যাগের সঙ্গে এটাও বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা তার ‘যাত্রাবিরতি’।
“নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে রাজনীতিতে স্বচ্ছভাবে ফিরে আসব,” বলেন সংসদীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞ এই নেতা।
নবগঠিত রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েই জীবনে প্রথম মন্ত্রী হওয়া সুরঞ্জিত বলেছিলেন, রেলে দুর্নীতির ‘কালো বিড়ালটি’ তিনি খুঁজে বের করতে চান। পাঁচ মাস বাদে তার পদত্যাগের কারণ হিসেবে জড়িয়ে গেল ‘দুর্নীতির ঘটনাই’।
দেড় দশক আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সুরঞ্জিত জরুরি অবস্থার সময় ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে পরিচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনার সরকারে শুরুতে ঠাঁই পাননি।
‘সংস্কারপন্থী’ অন্য নেতা আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের মতো দলের নীতি-নির্ধারণী কমিটির সদস্যপদও ‘হারাতে’ হয় সুরঞ্জিতকে।
তবে দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির এই সদস্য এই সরকারের সময়ে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পর সরকারের দুই বছর বাকি থাকতে মন্ত্রী হন।
মন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রেনসংখ্যা বাড়ানো এবং ট্রেন সময় ধরে চালানোর ক্ষেত্রে উন্নতির দাবি করে আসা সুরঞ্জিত পদত্যাগের সংবাদ সম্মেলনের পর রেলভবনের ষষ্ঠ তলার সভাকক্ষে দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিদায়ী বৈঠক করেন।
সেখানে তিনি গত কয়েক মাসে ‘অর্জিত’ রেলের গতি ধরে রাখার জন্য কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানান। অন্যদিকে কর্মকর্তারা বিদায় জানান তাদের মন্ত্রীকে।
দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের জন্য রেলভবনে গিয়ে পড়ন্ত বিকালে পতাকাহীন কালো রঙের একটি জিপে করে ওই ভবন ছাড়েন সুরঞ্জিত, শপথ নেওয়ার পর যিনি নিজের পরিচয় দিতেন, ‘শেষ বেলার মন্ত্রী’। |
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন