ঢাকা, এপ্রিল ১৬ - বিগত ইসি বারবার চেয়েও ব্যর্থ হওয়ার পর বর্তমান কমিশন তফসিল ঘোষণার পর মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করলেও সে অনুযায়ী নির্বাচন হচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে।
একটি রিট আবেদনে আদালত সোমবার দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ এই নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে।
আদালত যতদ্রুত সম্ভব ওয়ার্ড সীমানা নির্ধারণ করতে বলেছে, যা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আবেদনটি হয়েছিল। ওয়ার্ড সীমানা নির্ধারণের পর এখন নতুন করে তফসিল ঘোষণা করতে হবে ইসিকে।
প্রস্তুতি নিয়ে কাজে এগিয়ে যাওয়ার পর নির্বাচন আটকে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন বলেছে, তারা আদালতের আদেশ দেখে আপিল বা পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
বিএনপি অভিযোগ করেছে, সরকার নির্বাচন চায় না বলেই আইনে ‘ফাঁক’ রেখে নির্বাচনে স্থগিতের সুযোগ রেখে দিয়েছিল।
তবে বিরোধী দলের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতই ছিলেন।
যে আবেদনে সোমবার নির্বাচনী কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ আসে, রোববার তা করেছিলেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী।
আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ নির্বাচন স্থগিতের পাশাপাশি কয়েকটি নির্দেশ দেয়।
আদেশে যথাসম্ভব দ্রুত ওয়ার্ডগুলোর সীমানা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে তিন মাস পূর্ব পর্যন্ত সময়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে বলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী সব কাজ শেষ করে দ্রুত নির্বাচন করতে বলেছে আদালত।
এছাড়া সীমানা নির্ধারণসহ স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো বাস্তবায়ন করে তারপর নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসিকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছে আদালত।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিব, ঢাকার জেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা, দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসককে দুই সপ্তাহের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদেশের পর নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন করার একটি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে বিষয়টির কী হবে?
তখন আদালত বলে, এ বিষয়ে আদালত আদেশ দিয়েছে। সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে।
এর আগে শুনানিতে আদালত এই প্রসঙ্গে বলেছিল, আইনে ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে বলা রয়েছে। কিন্তু অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।
দৈনিক ইত্তেফাকের একটি প্রতিবেদনের ওপর আলোকপাত করে আদালত বলে, গত তিন বছর ভোটার তালিকা হালনাগাদ হয়নি। ফলে ৫ লাখ তরুণ প্রজন্মের নাগরিক ভোটার হতে পারেনি। এই সংখ্যা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মোট ভোটারের আট ভাগের একভাগ। এই সংখ্যাটি অনেক বড়। তাদের বাদ দিয়ে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে?
গত তিন বছর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ভোটার হালনাগাদ না হওয়ার তথ্য জেনে আদালত বিস্ময় প্রকাশ করে। এ বিষয়ে আদালত ওই প্রতিবেদনের লেখক দৈনিক ইত্তেফাকের আইন সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক সালেহউদ্দিনের বক্তব্য শোনেন।
শাহদীন মালিকও মোবাইল ফোনে কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনের সত্যতার বিষয়টি নিশ্চিত হন।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় আদালতের স্থগিতাদেশ এল।
ঢাকার একক সিটি কর্পোরেশন ভাগ করে গত বছর সৃষ্ট দুই সিটি কর্পোরেশনে ২৪ মে ভোট হওয়ার কথা ছিল।
আদেশের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, “এই আদেশের পর নির্বাচন হওয়ার তিন মাস আগেই ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে আবার তফসিল ঘোষণা করতে হবে।”
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের কয়েকটি ধারা বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত ডিসিসি নির্বাচন স্থগিতের আবেদন করেছিল হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯ এর ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, নতুন কোনো সিটি কর্পোরেশন হলে সীমানা নির্ধারণকারী কর্মকর্তাকে সুনির্দিষ্ট ওয়ার্ডের বিষয়ে সুপারিশ করতে হবে এবং কর্পোরেশনকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিভক্ত করতে হবে। এই ওয়ার্ডের সংখ্যা গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে।
ওই আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। সীমানা নির্ধারণের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে।
রিট আবেদনে বলা হয়, ঢাকাকে বিভক্ত করে দক্ষিণ ও উত্তরে দুটি সিটি কর্পোরেশন করায় এখন স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের ২৭ ও ২৮ ধারা বাস্তবায়ন না করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ নেই। এছাড়া নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়ে আইনের ৩, ৫, ২৯ ও ৩০ ধারাও লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় রিট আবেদনে।
শুনানিতে মনজিল মোরসেদ বলেন, “ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সম্পূর্ণ নতুন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এখন ইতিহাস। নতুন সিটি কর্পোরেশন হলে তার জন্য যে আইন তা অনুসরণ করতে হবে। সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। কাউন্সিলর সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু এখানে শিডিউলে কিছুই করা হয়নি।”
“গুলিস্তান থেকে রামপুরা পর্যন্ত একটা লোক হেঁটে গেল, আর বলল- এ পাশে উত্তর, ওই পাশে দক্ষিণ; এভাবে করলে তো আর হবে না। এটা ছেলের হাতের মোয়া নয়,” বলেন তিনি।
সরকার পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরশেন আইন দ্বারা বিভক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট দুটি সিটি কর্পোরেশন। আইনেই সরকারকে বিভক্তকরণের ক্ষমতা দিয়েছে। এ কাজ ইসির নয়, সরকারের।
“রিট আবেদনকারী যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তা নতুন সিটি কর্পোরেশনের জন্য প্রযোজ্য। নতুন সিটি কর্পোরেশন ঘোষিত হলে কীভাবে সীমানা নির্ধারন করতে হয়, তা আইনে বলা আছে। আর ঢাকায় আগে থেকেই যেহেতু সিটি কর্পোরেশন ছিল, তাই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওয়ার্ডগুলোর রি-নাম্বাারিংয়ের মাধ্যমেই সীমানা পুনঃ নির্ধারিত হয়ে গেছে।”
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “এ মুহূর্তে নির্বাচন যাতে বন্ধ না হয় আদালতে আমার সাবমিশনের মাধ্যমে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু আদালত রিট আবেদনকারীর আবেদন মঞ্জুর করে রুল ও স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।”
আদেশের পর ইসির আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, আপিলের বিষয়ে ইসির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রতিক্রিয়া
আদালতের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত যেমন রায় দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন, তেমনি তা অনুসরণ করার দায়িত্বও নির্বাচন কমিশনের।”
আদালতের আদেশের অনুলিপির জন্য অপেক্ষার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তা পাওয়ার পর করণীয নির্ধারণে আইন কর্মকর্তাসহ নির্বাচন কমিশন বৈঠক করবে।
অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র, বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা নবগঠিত দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আটকে যাওয়ার জন্য সরকারকে দায়ী করে বলেন, “এটা সরকারের একটি কৌশল। তারা আগেই বুঝে গেছে, তাদের জনপ্রিয়তার শূন্যের কোঠায়। তাই এখন সুকৌশলে আইনের ফাঁক খুঁজে নির্বাচনকে বন্ধ করেছে।”
২০০৭ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিল এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি। কিন্তু কয়েক দফায় চেষ্টা করেও স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন করতে পারেনি তারা।
নির্বাচন করতে না পারার জন্য বর্তমান সরকারের অসহযোগিতাকেই দায়ী করেছে বিগত ইসি। বিদায়বেলায় তা নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করেন এ টি এম শামসুল হুদা।
বিগত ইসির মেয়াদ শেষের মাসখানেক আগে সরকার ডিসিসি ভাগ করে নির্বাচন করতে বলেছিল শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসিকে। কিন্তু তখন ‘সম্ভবপর নয়’ বলে সরকারকে জানিয়ে দেয় তারা।
কাজী রকিব নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ডিসিসি নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। গত ৯ এপ্রিল তফসিল ঘোষণা করা হয়।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, আদালতের আদেশের আগে ডিসিসি’র দুই ভাগে মেয়র পদে ২৪টি এবং কাউন্সিলর পদে ১৩ শতাধিক মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। তবে আদেশের পর বিক্রি স্থগিত করা হয়েছে।
নির্বাচন না হওয়ায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে বর্তমানে সরকার মনোনীত সরকারি দুই কর্মকর্তা প্রশাসক হিসেবে কার্যত মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। |
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন